শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

খরার কবলে কৃষি, হুমকিতে খাদ্য নিরাপত্তা

নিতাই চন্দ্র রায়:

দেশে উৎপাদিত চালের শতকরা ৩৭ থেকে ৩৮ ভাগ আসে আমন ধান থেকে। আমন বৃষ্টিনির্ভর ফসল। শ্রাবণ মাস (মধ্য জুলাই থেকে মধ্য আগস্ট) হলো আমন ধান রোপণের উপযুক্ত সময়। এ সময় কৃষক বৃষ্টির পানিতে জমি তৈরি করে চারা রোপণ করেন। চারার বৃদ্ধি ও কুশি উৎপাদন পর্যায়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়। বোরোর মতো এই ধানে সেচ দিতে হয় না। কাইচ থোড় বের হওয়ার পর্যায়ে বৃষ্টি না হলো কোনো কোনো কৃষক একটি সম্পূরক সেচ দেন। অন্যান্য বছর এ সময়ে সারা দেশে আমন ধান রোপণের কাজ শেষ হয়ে যায়। শুধু বন্যাপ্রবণ এলাকায় বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিমাণ জমিতে নামলা আমনের চারা রোপণ করা হয়। গত জুলাই মাসে দেশে ৫৮ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগস্টেও কাক্সিক্ষত বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টি হবে এই আশায় সেচের সাহায্যে আমনের চারা রোপণ করে বিপদে পড়েছেন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক কৃষক। শ্রাবণ মাসের কাঠফাটা রোদে সেচ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে আমনের মাঠ। তারপর ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিং কৃষককে ফেলেছে মহাবিপদে।

আবহাওয়াবদিরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশেই নয়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের বিশেষ কিছু পরিস্থিতির কারণে পাশর্^বর্তী দেশগুলোতে এবং বিশে^র প্রায় সব অঞ্চলেই জুলাই ছিল উষ্ণ। আগস্ট মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। এমনকি মৃদৃ তাপপ্রবাহের পাশাপাশি দিন ও রাতের তাপমাত্রাও ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এক জলবায়ু বিশেষজ্ঞের মতে, ‘তথ্য-উপাত্তে কিন্তু দেখা যাবে মোট বৃষ্টিপাতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। বছর শেষে প্রায় একই রকম বৃষ্টি হয়। তবে মূল সমস্যা হলো- যখন বৃষ্টি হওয়া দরকার তখন হচ্ছে না।’ এখন করারও কিছু নেই। বৈরী পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদের নতুন শস্যবিন্যাস করতে হবে। সেই সঙ্গে আবহাওয়া সম্পর্কে কৃষককে সময় মতো সঠিক বার্তা দিতে হবে। এরইমধ্যে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পূর্বাভাস সত্য হলে আমন উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তাতে সন্দেহ নেই।

আমাদের চাল উৎপাদনের শতকরা ৯০ ভাগই আসে আমন ও বোরো থেকে। এখন যদি সেখানে ১০ শতাংশও কমে যায় তা হলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। দেশে বোরো মৌসুমে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয়। এবার আগাম বন্যায় দেশের হাওর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পাকা বোরো ধান তলিয়ে যাওয়াতে ক্ষতি হয় উৎপাদনের ১০ থেকে ১৫ ভাগ। একই কারণে ৫৬ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন কমেছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমনের চাষ পিছিয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে যাবে বোরো ধানের চাষ। গম, ভুট্টা, আলু, পেঁয়াজ, ডাল ও তেলবীজের চাষও পিছিয়ে যাবে একই কারণে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের বিদ্যমান শস্যবিন্যাস বিপর্যস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

শুধু ধানই নয়, তপ্ত মাটিতে তীব্র গরমে শুকিয়ে বিনষ্ট হচ্ছে গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি। ফসল বাঁচাতে কৃষককে সেচ দিতে হচ্ছে। তাতেও রক্ষা হচ্ছে না ফসল। বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, নাটোর, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, খুলনা ও বাগেরহাটে উঁচু জমি কিংবা পুকুর পাড়ে প্রচুর গ্রীষ্মকালীন সবজির চাষ হয়। দাম ভালো থাকায় প্রতি বছরই লাভের মুখ দেখেন কৃষক। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এবার দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। পটোল, চিচিঙ্গা, করলা, ডাঁটা, লালশাক, কাঁকরোল, চালকুমড়া, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, কচুরলতা, বরবটি, বেগুন, লাউ, কাঁচামরিচ কোনো ফসলেরই আশানুরূপ ফলন হচ্ছে না। বৃষ্টির অভাবে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সব সবজি ফসল। বাড়ছে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ। অনাবৃষ্টিতে কাঁচামরিচের উৎপাদন কমেছে সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক অবস্থায় এই সময়ে কাঁচামরিচের কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা থাকলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মোট মজুদ ১৯ দশমিক ৬৬ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ১৬ দশমিক ৯১ লাখ, গম ১ দশমিক ৪৫ লাখ এবং ধান ১ দশমিক ২০ লাখ টন। সরকারের কাছে ২২ মে পর্যন্ত অবশ্য মোট ১১ দশমিক ৫৯ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ ছিল, যেখানে ১০ দশমিক ৫১ লাখ টন চাল ও মাত্র ১ লাখ টনের কিছু বেশি গম। সেই হিসাবে মজুদের পরিমাণ বাড়লেও উদ্বেগ রয়েছে আমদানিনির্ভর খাদ্যশস্য গম নিয়ে। কেননা গত বছরের একই সময়ে দেশে গমের মজুদ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার টন এবং দুই বছর আগে ছিল ৩ দশমিক ৬০ লাখ টন। ভারত থেকে আবার গম আমদানি শুরু হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে রাশিয়া থেকে পাঁচ লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিলেও ২১ আগস্ট পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ৩২ হাজার মেট্রিক টন। আমদানি বাড়াতে ইতিমধ্যে আমদানি শুল্ক মওকুফ ও আবগারি শুল্ক ১৫ থেকে ১০ শতাশে হ্রাস করা হয়েছে।

ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ইতিমধ্যে ১০ থেকে ১২ টাকা বেড়েছে কেজিতে চালের দাম। বর্তমানে সারা দেশে খুচরা পর্যায়ে মোটা চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা, মাঝারি চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা ও চিকন চাল ৬৫ টাকা থেকে ৭২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আটা-ময়দার দামও বেড়েছে লাগামহীনভাবে। বর্তমানে আটা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা ও ময়দা ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। টিসিবির হিসাবে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। মাঝারি চালের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৮ এবং সরু চালের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।

দেশে গত বছর চালের ঘাটতি ছিল ৬ লাখ ১০ হাজার টন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, প্রতিকূল আবহাওয়া, উৎপাদন উপকরণের সংকটসহ নানা ধরনের বিপর্যয় বিবেচনায় নিলে ২০৩০ সালে চালের ঘাটতি দাঁড়াবে ৩৬ লাখ টন। আর ২০৫০ সালে চালের ঘাটতি কিছুটা কমে দাঁড়াবে ১৯ লাখ টনে। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতি বা বিপর্যয়ে না পড়লে চালের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হতে পারে বাংলাদেশে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের মিলনায়তনে ২০৩০ ও ২০৫০ সালে নির্বাচিত ৩৫টি ফসলের (খাদ্যশস্য) চাহিদা ও জোগানের প্রাক্কলন শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০৩০ সালে মানুষের খাদ্য হিসেবে এবংঅন্যান্য প্রয়োজনে চালের মোট চাহিদা হবে প্রায় তিন কোটি ৯১ লাখ টন এবং ২০৫০ সালে প্রায় চার কোটি ২৬ লাখ টন। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে চালের উৎপাদন হবে যথাক্রমে প্রায় তিন কোটি ৫৫ লাখ টন এবং চার কোটি সাত লাখ টন। ফলে ২০৩০ সালে প্রায় ৩৬ লাখ টন এবং ২০৫০ সালে প্রায় ১৯ লাখ টন চালের ঘাটতি হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের ভাষ্য হলো- বাংলাদেশে ধানের নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে ব্রি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে নতুন ধান প্রযুক্তি পাওয়া যাবে এবং কৃষক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য হবে।

আগামী দশকে দেশের কৃষি উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সেচের পানির অভাব ইত্যাদি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এটি মোকাবিলায় অধিক উৎপাদনশীল নতুন ধান প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করা ও ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত কার দরকার। সেই সঙ্গে ডিজেল ও সারে ভর্তুকি বাড়ানো প্রয়োজন।

লেখক: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন

masumbillah65@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION